যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে বাস্তুচ্যুত ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে বাস্তুচ্যুত ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ

গত দু’দশকে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে বাড়িঘর হারিয়েছেন ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। একসময় যাদের বাড়িঘর ছিল, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সোমালিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপিন্স এবং লিবিয়ায়। ‘কস্ট অব ওয়্যার রিপোর্টে’ এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

ইরাক

সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ইরাকের জনগণ। যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় দেশটির ৯২ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন।

২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ অভিযোগ করেন, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী রাসায়নিক এবং জৈব অস্ত্র রয়েছে। পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চাচ্ছেন তিনি। সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন সাদ্দাম হোসেন, যা শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।

২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকে আক্রমণ করেন বুশ। ওই যুদ্ধ চলে ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৮ বছর ৮ মাসের বেশি স্থায়ী ইরাক-মার্কিন যুদ্ধ। ক্ষমতাচ্যুত করা হয় বাথ পার্টিকে। ফাঁসি দেওয়া হয় প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে। সাদ্দাম হোসেন এবং বাথ পার্টির পতনের মধ্য দিয়ে দেশটিতে বিভিন্ন বিদ্রোহীগোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠে।

ওই যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পরিসংখ্যান রয়েছে। ২০০৬ সালে লেনসেট স্ট্যাডি জানায়, ৬ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক লাখ ৮৫ হাজার থেকে ২ লাখ ৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি সংখ্যা জানা যায়নি।

ইরাকে পাওয়া যায়নি গণবিধ্বংসী কোনো অস্ত্র।

সিরিয়া

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সিরিয়ার ৭১ লাখ মানুষ বাড়িছাড়া হয়। ঘটনার সূত্রপাত ২০১১ সালে। দেশটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ থেকে প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের পদত্যাগ, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কারের দাবি জানানো হয়। সরকার বলপ্রয়োগ করলে বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিদেশি শক্তি এবং সন্ত্রাসী সংগঠন।

২০১১ সাল থেকে আসাদকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৪ সালে ওবামা প্রশাসন সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে। ২০১৫ সালে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটিকে প্রতিহতে দেশটিতে সেনা মোতায়েন করে ওয়াশিংটন।

সিরিয়া যুদ্ধে অনুমানিক ৩ লাখ ৮৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা অজানা।

আফগানিস্তান

আফগানিস্তানের ৫৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, যা বাস্তুচ্যুতের সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনা ঘটে। দায়ী করা হয় আল-কায়েদাকে। আল-কায়েদাকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয় সে সময়কার আফগান শাসক তালেবানের বিরুদ্ধে।

ওই বছরের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতায় ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযান জোরদারের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন বাইডেন।

আফগান যুদ্ধে কত মানুষ নিহত হয়েছে, তার সঠিক তথ্য নেই। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, এক লাখ থেকে দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে মার্কিন সমর্থিত সরকারের সঙ্গে চলছে আলোচনা। থেমে নেই তালেবান, আইএস ও সরকারি বাহিনী ত্রিমুখী সংঘাত।

ইয়েমেন

ইয়েমেনের ৪৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শুরুটা ২০০২ সাল থেকে। দেশটিতে আল-কায়েদা তৎপরতা চালাচ্ছে এমন অভিযোগ ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩৩৬টি ড্রোন হামলা চালায় ওয়াশিংটন। এতে নারী শিশুসহ অন্তত দেড় হাজার বেসামরিকের মৃত্যু হয়।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইরানের সমর্থনে দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আবদে রাব্বু মানসুর হাদিকে ক্ষমতাচ্যুত করে হাউথি বিদ্রোহীরা।

সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠমিত্র হাদি রিয়াদে পালিয়ে আশ্রয় নেন। তাকে ক্ষমতায় ফেরাতে ২০১৫ সালের মার্চে ইয়েমেনে হাউথিবিরোধী অভিযানে নামে সৌদি জোট। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসরসহ রিয়াদের মিত্ররা। জোটকে সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ। জোটকে অস্ত্রশস্ত্রসহ সব ধরনের সামরিক কৌশলগত সহায়তা দিচ্ছে তারা।

ইরানের সমর্থিত হাউথি এবং পশ্চিমা সমর্থিত সৌদি জোটের সংঘাতে ২ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। মানবিক খাদ্যসংকটে আছে লাখ লাখ মানুষ। বর্তমানে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি ইয়েমেন।

সোমালিয়া

জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন ২০০২ সালে ‘ওয়ার অন টেররিজম’ ঘোষণার পরপরই সোমালিয়ায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। জিবুতির মার্কিন ঘাঁটি ব্যবহার করে অভিযুক্ত মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে ড্রোন হামলা চালায় ওয়াশিংটন। ২০০৬ সালে মার্কিন গোয়ান্দা সংস্থা সিআইএ সমর্থিত ইথিওপিয়া সোমালিয়ায় হামলা চালায়। তাদের লক্ষ্য ছিল দেশটির ক্ষমতা থেকে ইসলামি কোর্টস ইউনিয়নকে (আইসিইউ) ক্ষমতাচ্যুত করা।

যুক্তরাষ্ট্র এবং ইথিওপিয়ার নেতাদের অভিযোগ আইসিইউ আল-কায়েদার মিত্র। তাদের এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে আইসিইউ।

আল শাবাব নামে আইসিইউর সশস্ত্র শাখা ২৯১২ সালে আল-কায়েদার সঙ্গে জোট ঘোষণা করে। জাতিসংঘ সমর্থিত সোমালিয়ার সরকারি বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সঙ্গীদের নিয়ে আল শাবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। চলমান এ যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৪২ লাখ মানুষ। নিহত হয় ৫ লাখ।

পাকিস্তান

২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার সময় পাকিস্তানের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে পালিয়ে আশ্রয় নেয় তালেবান এবং আল-কায়েদার সদস্য। সেখানে তাদের মধ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পরে। ওই যুদ্ধে অংশ নেয় যুক্তরাষ্ট্রও। পাকিস্তানের ভূখণ্ড থেকে ওয়াশিংটন আল-কায়েদা এবং তালেবানকে লক্ষ্য করে ড্রোন, বিমান হামলা চালায়। বিনিময়ে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হয় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। চতুর্মুখী অভিযানে জীবন বাঁচাতে বাড়িছাড়া হন ৩৭ লাখ মানুষ।

ফিলিপিন্স

২০০২ সালে ৪০ বছর পুরনো সংঘাত নিরসনে ফিলিপিন্সের সরকারকে সহায়তায় দেশটিতে মার্কিন বিশেষ বাহিনী এবং সামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র। মিন্দানাওভিত্তিক মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট এবং আবু সাইয়াফ গ্রুপ যাদের আল কায়েদার সহযোগী বলা হতো তাদের সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দেয় যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপিন্স। ২০১৬ সালে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে মিত্রতা ঘোষণা করে বিদ্রোহীরা।

ফিলিপিন্সে অন্তত ৬ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয়। ফিলিপিন্সের বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে ১৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

লিবিয়া

দেশটির ১২ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। লিবিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ন্যাটোকে সর্বাত্মক সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা জানান, গাদ্দাফি লিবিয়ার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী দিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। নাগরিকদের হত্যা করছে। বাধ্য হয়ে লিবিয়ার নাগরিকরা প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিচ্ছে। লিবিয়াসহ প্রতিবেশী মিসর, তিউনিসিয়ায় মানবিক সংকট তৈরির শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুতের পর গাদ্দাফিকে হত্যা করে মার্কিন সমর্থিত বিদ্রোহীরা।

সংঘাতে কত মানুষ হতাহত হয়েছে প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। আড়াই থেকে ২৫ হাজার পর্যন্ত মানুষ মারা যেতে পারে বলে বিভিন্ন সময়ের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া সংঘাত এখনো চলছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন